পৃথিবী নামের আমাদের এ গ্রহটিতে রয়েছে মোট ১৯৫টি দেশ। দেশগুলো বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত। এগুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বাধীন ও সার্বভৌম হলেও, আজকের বিশ্বে কোনো দেশের পক্ষেই অন্যের সহযোগিতা ছাড়া একা চলা সম্ভব নয়। অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এমন কি রাজনৈতিক দিক দিয়েও দেশগুলো একে অপরের উপর কমবেশি নির্ভরশীল। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা ও নিজেদের উন্নয়নের লক্ষ্যে তাদের পরস্পরের সহযোগিতা নিতে হয়। যেমন একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে বাংলাদেশের খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের একার পক্ষে এগুলোর সমাধান সম্ভব নয়। এজন্য অন্য দেশ ও সংস্থার সহযোগিতা প্রয়োজন হয় । একইভাবে বিশ্বের অন্যান্য দেশেরও রয়েছে অনেক সমস্যা। সকলের সহযোগিতার মাধ্যমে এসব সমস্যার সমাধান ও একটি শান্তিময় বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে পৃথিবীতে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থা। এরমধ্যে কতগুলো গড়ে উঠেছে নির্দিষ্ট অঞ্চলকে ঘিরে অর্থাৎ ঐ অঞ্চলের দেশগুলোকে নিয়ে। যেমন : সার্ক, আসিয়ান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আফ্রিকান ইউনিয়ন প্রভৃতি। আবার কতগুলোর বিস্তৃতি ঘটেছে বিশ্ব জুড়ে। যেমন : জাতিসংঘ, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন, ওআইসি, ইউনেস্কো, ইউনিসেফ, ফাও, ইউএনএফপিএ, ন্যাটো, ইউএনডিপি, হু প্রভৃতি। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে আমরা অনেকগুলো আঞ্চলিক সংস্থা সম্পর্কে জেনেছি। অষ্টম শ্রেণিতে আমরা ইউনিসেফ, ইউনেস্কো, ইউএনডিপি, ফাও, হু, ইউএনএফপিএ সম্পর্কে জানব।
এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা-
• বিশ্বে বিভিন্ন দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারব;
• উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থা যেমন- ইউনিসেফ, ইউনেস্কো, ইউএনডিপি, ফাও এবং
• ইউএনএফপি-এর গঠন, উদ্দেশ্য ও কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিতে পারব ;
• আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সম্পর্ক উন্নয়নে এসব সংস্থার ভূমিকা মূল্যায়ন করতে পারব;
• বিভিন্ন সংস্থায় বাংলাদেশের সংশ্লিষ্টতা বিশ্লেষণ করতে পারব;
• আন্তর্জাতিক সম্প্রীতি ও পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্কে উদ্বুদ্ধ হব ।
জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক জরুরি শিশু তহবিল বা United Nations International Children's Emergency fund (UNICEF) জাতিসংঘের একটি বিশেষ সংস্থা যা বিভিন্ন দেশের বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশের শিশুদের সেবা প্রদান করে। মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও রোগ প্রতিরোধ, প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা, মৌলিক শিক্ষা, স্যানিটেশন ও নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে এ প্রতিষ্ঠানটি কাজ করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের ত্রাণ সাহায্য প্রদানের লক্ষ্যে ইউনিসেফ ১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫০ সালের পর থেকে এটি বিশ্বের স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের শিশুদের কল্যাণ ও উন্নয়নে কাজ করে আসছে। ইউনিসেফ এর সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক-এ অবস্থিত। ১৯৬৫ সালে ইউনিসেফ শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পায়। ১৯৫১ সালে ঢাকায় ইউনিসেফের অফিস প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৯৭৭ সাল থেকে ইউনিসেফ নিয়মিতভাবে এ দেশের মা ও শিশুর উন্নয়নে কাজ করছে।
কাজ : ইউনিসেফ তৃতীয় বিশ্বে কী কী নিয়ে কাজ করছে?
ইউনেস্কো জাতিসংঘের একটি সামাজিক সংস্থা, এ সংস্থার পুরো নাম United Nations Educational Scientific and Cultural Organization (UNESCO) অর্থাৎ‘জাতিসংঘ শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা'। ১৯৪৬ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে এর সদর দপ্তর অবস্থিত। বর্তমানে ১৯৫টি রাষ্ট্র ইউনেস্কোর সদস্য। ইউনেস্কোর প্রধান লক্ষ্য হলো শিক্ষা, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন জাতির মধ্যে সহযোগিতা সৃষ্টির মাধ্যমে বিশ্বে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। পৃথিবীর সব মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার, আইনের শাসন ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করার লক্ষ্যে ইউনেস্কো কাজ করে যাচ্ছে। ইউনেস্কোর মূল কাজের ক্ষেত্র চারটি-শিক্ষা, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও যোগাযোগ।
বাংলাদেশ ১৯৭২ সালের ২৭ শে অক্টোবর ইউনেস্কোতে যোগ দেয়। ১৯৭৩ সালে সরকার ‘বাংলাদেশ ইউনেস্কো কমিশন' গঠন করে। এ কমিশন বাংলাদেশে ইউনেস্কোর কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহায়তা করে। ইউনেস্কো বাংলাদেশ থেকে নিরক্ষরতা দূরীকরণ, বিশেষ করে বয়স্কদের শিক্ষা, বিজ্ঞান শিক্ষার উন্নয়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ইউনেস্কোর উদ্যোগেই আমাদের ভাষা শহিদ দিবস ২১শে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসাবে সারা বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এছাড়া বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ঐতিহ্য সুন্দরবন ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য (যেমন বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ ও নওগাঁর পাহাড়পুর বা সোমপুর বৌদ্ধবিহার) সংরক্ষণেও ইউনেস্কো সহায়তা করছে।
কাজ : বাংলাদেশে ইউনেস্কোর উন্নয়নমূলক কার্যক্রম দেশকে এগিয়ে নিতে কী ভূমিকা পালন করছে মূল্যায়ন করো ৷
ইউএনডিপি ১৯৬৫ সালে গঠিত হয়। এর পুরো নাম United Nations Development Programme (UNDP)। এটি জাতিসংঘের বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন ও তদারকি করে থাকে। নিউইয়র্কে এর সদর দপ্তর অবস্থিত ।
বিশ্ব থেকে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়নে সহায়তা করা ইউএনডিপি-র প্রধান কাজ। এই প্রতিষ্ঠানটি প্রধানত ৬টি ক্ষেত্র নিয়ে কাজ করে যথা : গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা; দারিদ্র্য দূরীকরণ; সংকট মোকাবিলা; পরিবেশ ও এনার্জি সংরক্ষণ; তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং এইচআইভি (HIV) ও এইডস (AIDS)।
১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নে ইউএনডিপি সহায়তা করে আসছে। ইউএনডিপি বাংলাদেশ থেকে দারিদ্র্য দূরীকরণ, গ্রামাঞ্চলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, নারী উন্নয়ন, সুশাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, পরিবেশের উন্নয়ন ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাহায্য ও সহযোগিতা করছে।
কাজ : বাংলাদেশের উন্নয়নে ইউএনডিপির ভূমিকা মূল্যায়ন করো।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা FAO এর পুরো নাম Food and Agriculture Organization | এটি ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪টি দেশ এর সদস্য। এর সদর দপ্তর ইতালির রাজধানী রোমে । সংস্থাটি সারা বিশ্বে ক্ষুধার বিরুদ্ধে কাজ করছে। ক্ষুধা ও অপুষ্টি দূরীকরণের মাধ্যমে বিশ্বে খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং জনগণের জীবনমান উন্নয়ন হচ্ছে ফাও-এর প্রধান লক্ষ্য।
বাংলাদেশ ফাও-এর একটি সদস্য রাষ্ট্র। ঢাকায় এর শাখা অফিস আছে। বাংলাদেশের খাদ্য ও কৃষির উন্নয়নে ফাও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বাংলাদেশ খাদ্যে পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। উপরন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রায়ই আমাদের দেশে খাদ্য সংকট দেখা দেয়। এই সমস্যার মোকাবিলায় একটি খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ফাও সরকারকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সাহায্য দেয়। এছাড়াও ফাও খাদ্যদ্রব্য সরবরাহে সহায়তা ও কৃষির উন্নয়নে পরামর্শ দিয়ে থাকে । জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় সহায়তা করে। ঝড় ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদে ও প্রান্তিক চাষিদের প্রযুক্তিগত সহায়তাও দেয় সংস্থাটি।
কাজ : বাংলাদেশে খাদ্য সমস্যা সমাধানে ফাও-এর ভূমিকা মূল্যায়ন করো।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা WHO এর পুরো নাম World Health Organization। এটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনস্বাস্থ্য রক্ষায় একটি সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে কাজ করে। ১৯৪৮ সালের ৭ই এপ্রিল এটি গঠিত হয়। সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে এর সদর দপ্তর অবস্থিত। বিশ্বের সকল অংশের মানুষের জন্য সর্বোচ্চ স্বাস্থ্য সুবিধা নিশ্চিত করাই সংস্থাটির লক্ষ্য ।
বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে 'বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা' গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। দেশ থেকে সংক্রামক ব্যাধি দূর করতে সাহায্য করছে। শিশুদের ৬টি ঘাতক রোগ (হাম, ডিপথেরিয়া, টিটেনাস, যক্ষ্মা, পোলিও, হুপিং কাশি প্রভৃতি) প্রতিরোধেও সংস্থাটি অবদান রাখছে। এছাড়া দেশ থেকে ম্যালেরিয়া দূরীকরণ, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতি, মাতৃ ও শিশু মৃত্যু হার কমানোর জন্যও কাজ করছে সংস্থাটি। কলেরা ও ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অবদান উল্লেখযোগ্য ।
কাজ : শিশুদের ছয়টি ঘাতক রোগের প্রতিরোধে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ভূমিকা বর্ণনা করো।
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল UNFPA এর পুরো নাম United Nations Population Fund (পূর্বনাম United Nations Fund for Population Activities)। এটি ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সদর দপ্তর নিউইয়র্কে। বিশ্বের ১৪০টিরও বেশি দেশ ইউএনএফপিএ-র সদস্য। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত আঞ্চলিক অফিসের মাধ্যমে ইউএনএফপিএ তার কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তাদের জনসংখ্যা সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহায়তা প্রদানই হচ্ছে ইউএনএফপিএ-এর মূল লক্ষ্য। এটি জনসংখ্যা সম্পর্কিত তথ্য সরবরাহের মাধ্যমে দেশগুলোর জনসংখ্যা নীতি প্রণয়ন এবং কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহায়তা করে।
বাংলাদেশ বিশ্বের একটি অধিক জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশ। এই অতিরিক্ত জনসংখ্যা বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট সমস্যা। এ সমস্যা মোকাবিলায় ইউএনএফপিএ দীর্ঘদিন যাবত বাংলাদেশকে সহযোগিতা করছে। পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিকে এগিয়ে নেওয়া, নারীর ক্ষমতায়ন প্রভৃতি বিষয়েও ইউএনএফপিএ বাংলাদেশ সরকারকে পরামর্শ ও সহযোগিতা দিচ্ছে। ইউএনএফপিএ-র সহায়তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পপুলেশন সায়েন্স বিভাগ চালু হয়েছে। এ বিভাগটি বাংলাদেশ ও বিশ্বের জনসংখ্যা সম্পর্কিত জ্ঞানদানের পাশাপাশি এ বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।
কাজ : বাংলাদেশের জনসংখ্যা মোকাবিলায় ইউএনএফপিএ-র অবদান মূল্যায়ন করো।